শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ০৪:২১ অপরাহ্ন

শিরোনামঃ

বাল্যবিবাহ মুক্ত বাংলাদেশের প্রতিশ্রতি

 

লেখক: সঞ্জয় মন্ডল
উন্নয়ন কর্মী-শিশু সুরক্ষা ও অ্যাডভোকেসি
ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ

আয়েশা- লেখাপড়া শেষ করে সে তার গ্রামের স্কুলে শিক্ষিকা হবে। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলার ছোট্ট মেয়ে আয়েশা (ছদ্মনাম)। ১৩ বছরের আয়েশা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী। আয়েশার শীর্ণকায় চেহারায় চোখে-মুখে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে শিক্ষিকা হবে। কিন্তু পরিবারে আয় বলতে বাবার অনিয়মিত দিনমজুরির কাজ। দারিদ্র্য, ঋণ আর লোকলজ্জার চাপে আয়েশার বাবা-মা এক প্রবাসীর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন, বয়সে প্রায় তার বাবার সমান। বিয়ের দিন সকালে আয়েশা তার স্কুল শিক্ষিকার পা জড়িয়েধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল-“আপা, পেটের দায়ে মা বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই আপা…” সেদিন শিক্ষিকা, উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন পরিচালিত শিশু ফোরাম ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সেই বিয়ে বন্ধ করতে সমর্থ হয়। আয়েশা আবার স্কুলে ফিরে আসে। কিন্তু সমাজে শত শত আয়েশা এখনও সেই সাহস পায় না। তাদের কান্না চাপা পড়ে যায় পারিবারিক ভাঙন, আর সামাজিক চাপের মুখে।
সর্বশেষ সরকারি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪১.৬ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক -২০২৩ (বিএসভিএস-২০২৩) জরিপেও গত তিন বছরে বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা গেছে। ২০২২ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, কমপক্ষে ৪০.৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়েছে, ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩২.৪ শতাংশ এবং ২০২০ সালে এটি ছিল ৩১.৩ শতাংশ। বিএসভিএস-২০২৩ এ আরও দেখা গেছে যে ৮.২ শতাংশ মেয়ে শিশুর ১৫ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়েছিল।
জাতিসংঘের ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৫ লক্ষ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকে। প্রান্তিক, দরিদ্র ও জলবায়ু-প্রবণ এলাকাগুলিতে এই হার ৬০%-এরও বেশি। এর অর্থ, প্রতিদিন আমরা একজন কিশোরীর ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রতারণা করছি। আমাদের একটি জাতিগত প্রতিশ্রæতি ”শিশুরা পড়ালেখা করবে, বড় হবে, সিদ্ধান্ত নেবে” এই মৌলিক অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।
সমাজের এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটেও আশার আলোদেখি যখন ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশের মত শিশুকেন্দ্রিক উন্নয়ন সংস্থা সমাজকে স্বপ্ন দেখায় বাল্যবিবাহ মুক্ত বাংলাদেশের। ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ ২০২৩ সাল থেকে বাল্যবিবাহ মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে কর্মএলাকায় ২৮টি জেলায় এবং ৮১টি উপজেলায় ”শূন্য বাল্যবিবাহ” নামে একটি বিশেষ প্রচারাভিযান পরিচালনা করছে। স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয়নেতা, শিক্ষক, গ্রামউন্নয়ন কমিটি, শিশু ও যুবকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহোযোগীতায় সংস্থাটি বছরব্যাপি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এভাবে এলাকাটিতে যখন বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তখন সমীক্ষায় প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে স্থনাীয় সরকার উক্ত এলাকাটিকে বাল্যবিাহমুক্ত ঘোষণা করেন। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ”শূন্য বাল্যবিবাহ” প্রচারাভিযান এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৪৪৭টি গ্রামকে বাল্যবিাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও ২৮টি উপজেলায় প্রায় ৫৫,০০০ কিশোরীকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করাহয়েছে এবং প্রায় ১০,০০০ কিশোরীকে স্কুলে ফেরত যেতে সহায়তা, স্যানিটেশন সহায়তা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা দিয়েছে।
ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ বিশ^াস করে বাল্যবিবাহমুক্ত বাংলাদেশ মানে, প্রতিটি কিশোরী নিজেই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবে এবং প্রতিটি সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে একটি নিরাপদ আশ্রয় ও উৎসাহের স্থান। জাতি হিসেবে আজ আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। সময় এখন প্রতিশ্রæতি পূরণে এগিয়ে যাওয়ার। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে কেবল আইন নয়, দরকার বিশ্বাস, ভালোবাসা, সামাজিক প্রতিরোধ ও কমিউনিটির নেতৃত্ব।
১,৪৪৭টি গ্রাম আমাদেরকে আশার আলো দেখায়। তাদের আলো দেশের বাকি অংশকে এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করুক যেখানে কোনও শিশুকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে না। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই। এটি জাতির শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং লিঙ্গ সমতার জন্য লড়াই। এজন্য সরকার, নাগরিক সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিকের এই প্রচেষ্টাগুলিকে আরও জোরদার করার সময় এসেছে। আমরা যদি চাই, সমাজে হাজারো মেয়ে তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাবে অদম্য উৎসাহে। আজ থেকে অনাগত দিনে আয়েশারা যেন নিজের জীবনের গল্প নিজেরাই লিখতে পারে, তার জন্য চাই আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং সুদৃঢ় অঙ্গীকার। আসুন, আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি ইউনিয়ন এবং প্রতিটি উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত করার অঙ্গীকার করি।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *